অবৈধভাবে
পরিচালিত হচ্ছে ২০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সারা দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের ৩
শতাধিক ক্যাম্পাসও চলছে অবৈধভাবে। ক্যাম্পাসগুলোতে যেসব কোর্স ও প্রোগ্রাম
পাঠ্য তাতেও নেই সরকারি অনুমোদন। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, ‘বিদেশী
বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে যারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে, তাদেরও সরকারি অনুমোদন
নেই। যে কারণে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত সনদ বাস্তব জীবনে কোনো কাজে আসছে
না।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি তরফে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সাবধান থাকতে বলা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান,
‘১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা কালো তালিকাভুক্ত করেছি।
এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের আইন-কানুন মানতে চায় না। তারা আদালতের নিষেধাজ্ঞা
নিয়ে চলছে। এখন আমরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মামলাগুলোর এক কোর্টে এনে
নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করব। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক আতফুল হাই শিবলি শনিবার বিকালে মোবাইল ফোনে জানান,
‘অবৈধ
ও ভুয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের ক্যাম্পাস সম্পর্কে
শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে আমরা খুব শিগগিরই একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করব। এ
নিয়ে কাজ চলছে।’ তিনি আরও বলেন,
‘আইনত কোনো বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত নয়।’ উচ্চ মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
এ
পরিস্থিতিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের খাঁচায় ভরতে একশ্রেণীর শিক্ষা বেনিয়া
‘বিশ্ববিদ্যালয়’র ফাঁদ পেতে বসেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় সারা দেশেই
দেশী-বিদেশী অবৈধ ও ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতারকরা।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের অন্তত তিন শতাধিক অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়
বা ক্যাম্পাস রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই প্রতারিত
হয়েছেন। লাখ লাখ টাকা খরচ ও বছরের পর বছর পার করেও বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী
তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চলতি মৌসুমে সরকার
একদফা বৈধ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় দফায়
সমস্যাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়েরও তালিকা প্রকাশ করবে বলে জানা গেছে।
সূত্রগুলো
জানায়, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং যারা অবৈধ
আউটার ও শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে সরকার মূলত তাদের ব্যাপারে এ যাত্রায়
সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি জারি করবে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১২টি। এছাড়া ২টি
প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা বহু আগেই সরকার কর্তৃক কালো তালিকাভুক্ত, কিন্তু
আদালতে মামলা করে স্থিতাদেশের জোরে চলছে। ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩টি।
বাকিগুলো নানা অবৈধ কার্যক্রমে জড়িত এবং সরকারের সঙ্গে সেগুলোর মামলা চলমান
রয়েছে।
যে ২০ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সাবধান ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন ।
জানা গেছে,
শিক্ষা
মন্ত্রণালয় ২৬ জুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবৈধ কার্যক্রম সংক্রান্ত
একটি প্রতিবেদন এ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠিয়েছে। এছাড়া অবৈধ
ক্যাম্পাস বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও একাধিক পত্রও
দিয়েছে।
সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে,
১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মামলাসংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে।
এগুলো হচ্ছে- দি পিপলস, দারুল ইহসান, প্রাইম, অতীশ দীপংকর
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন, নর্দার্ন, বিজিসি
ট্রাস্ট, ইবাইস, আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ
ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি
অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি), ইন্টারন্যাশনাল
ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য জটিলতাও রয়েছে।
এর মধ্যে প্রথম নয়টি অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে।
এক্ষেত্রে অবশ্য কেউ কেউ উচ্চ আদালতের স্থিতাদেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার
করছে। এই নয়টির মধ্যে আবার দারুল ইহসান, প্রাইম এবং ইবাইস নিয়ে মালিকানা
দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর মধ্যে দারুলের চারটি পক্ষ মিলে সারা দেশে অন্তত ১৪০টি
অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।
এই চার পক্ষের একটি হচ্ছে
উত্তরার জনৈক আবুল হোসেন। তিনি প্রাইম ইউনিভার্সিটিরও মালিক দাবিদার। অবশ্য
প্রাইমের (মিরপুরের ২এ/১, নর্থ দারুস সালাম রোড মিরপুর ১ নম্বর বাদে)
উত্তরার বিএনএস সেন্টারসহ যত অবৈধ ক্যাম্পাস আছে তা উচ্ছেদের ব্যাপারে
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পত্র দিয়েছে। এ পত্রের
পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মহাপুলিশ পরিদর্শককে
(আইজিপি) চিঠি দেয়া হয়। যদিও গত তিন দিনেও পুলিশের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাস
উচ্ছেদে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। এছাড়া ইবাইস ইউনিভার্সিটি নিয়েও
মালিকানা দ্বন্দ্ব রয়েছে। পাশাপাশি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক অবৈধ
ক্যাম্পাসও রয়েছে।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা দ্বন্দ্ব এবং অবৈধ
ক্যাম্পাস রয়েছে, ওইসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি না হওয়ার পরামর্শ
দিয়েছেন ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. আতফুল হাই শিবলি। তিনি বলেন, এসব
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে এক ধরনের ঝুঁকি থেকে যায়। বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসন সংখ্যার কোনো সংকট নেই। তাই ইউজিসির ওয়েবসাইট
দেখে ও খোঁজখবর নিয়েই শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়া উচিত।
জানা গেছে, আউটার
ক্যাম্পাস বাণিজ্যে আরও যারা লিপ্ত রয়েছে তাদের মধ্যে একটি ইন্টারন্যাশনাল
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব চিটাগাং (আইআইইউসি)। এই প্রতিষ্ঠানটি মামলার জোরে
ঢাকায় একটি ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। এর বাইরে চট্টগ্রামের বহদ্দার হাটেও একটি
ক্যাম্পাস তারা খুলেছে বলে জানা গেছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া সম্প্রতি
রাজশাহীতে অবৈধ একটি ক্যাম্পাস খুলেছে বলে ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে।
এর
বাইরে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, পিচব্লেন্ড, মদিনাতুল উলুম
বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি ভুয়া
বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাস্তবে এসব নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়নি
সরকার। জানা গেছে, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির নামে ঢাকাসহ
বিভিন্ন স্থানে যিনি ক্যাম্পাস চালাচ্ছেন, তিনি এর আগে পিচব্লেন্ড নামে
অবৈধ আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতেন। পিচব্লেন্ড সরকার বন্ধ করে দেয়ার পর
মাঝখানে বেশ কিছু দিন তিনি নিবৃত্ত ছিলেন। এখন আবার জনগণকে প্রতারিত করতে
প্রিমিয়ারের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছেন। এর বাইরে রাজশাহী অঞ্চলে
‘মদিনাতুল উলুম বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে আরও একটি ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয়া হয়েছে।
আমেরিকান
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিও এক সময়ে অবৈধভাবে পরিচালিত হতো। সরকারের কড়াকড়ির
কারণে এটি বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এটি ফের চালু হয়েছে বলে
মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে দেখা গেছে। আমেরিকান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি (আমবান)
সরকার বন্ধ ঘোষণা করলেও তারা সারা দেশে ২২টি অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। একই
ভাবে কুইন্স ইউনিভার্সিটিও অবৈধভাবে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকার কয়েক
বছর আগে এদের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে।
চটকদার বিজ্ঞাপনের বাহার :
এদিকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেও একশ্রেণীর প্রতিষ্ঠান মাথাচাড়া দিয়ে
উঠেছে। এর বাইরে যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, সাইপ্রাসসহ বিশ্বের বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদিতে ভর্তির ফাঁদও রয়েছে, যার চটকদার
বিজ্ঞাপন প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই নজরে পড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর
ফলে অনেকেই প্রতারিত হতে পারেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তাদের
হিসাবেই বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ৬৮টি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় বা এর
শাখা ও স্টাডি সেন্টার রয়েছে। তবে বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠান শতাধিক রয়েছে বলে
জানা গেছে। এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একদিকে অভিভাবক-শিক্ষার্থী অন্যদিকে
সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে সজাগ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন
সংশ্লিষ্টরা।
অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিসের সাবেক
সহ-সভাপতি ও ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আবুল কাশেম
হায়দার বলেন, অবৈধ ক্যাম্পাস এবং সনদ বাণিজ্যের ব্যাপারে সমিতি সব সময়ই
সোচ্চার। তাদের পক্ষ থেকে অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যাম্পাসের বিষয়ে বারবার
বলার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো এক শ্রেণীর কর্মকর্তা এসব
প্রতিষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দেয়, আবার কেউ কমিশন নেয়।